
শৌখিনতার বশে কিংবা ঘরের মনোরম আভিজাত্য সাজাতে ক্যাকটাস এক পরিচিত উদ্ভিদকুল। বেশিরভাগ ক্যাকটাস পুরু, চ্যাপটা ও ডিম্বাকৃতি। অন্য কথায়, এই গাছগুলি গরম এবং শুষ্ক অবস্থায় বেড়ে ওঠার উপযোগী। উদ্ভিদগুলি উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমি, ইউরোপের কিছু অংশ এবং আফ্রিকার কিছু অংশের আদি নিবাস।
দীর্ঘ সময় ধরে পানি সঞ্চয় করা তাদের অনন্য ক্ষমতা । মরুভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য তারা অভিযোজিত। যেহেতু মরুভূমিতে খুব কমই বৃষ্টি হয়, তাই এই ক্যাকটাস দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণ করে। ক্যাকটাস সাধারণত পটে চাষ করা হয়।
টবে ক্যাকটাসের জন্য মাটি তৈরি
আমাদের দেশে টবে বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাসের চারা লাগানো হয়। এটি গাছপ্রেমীদের মাঝে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই কারণে টবে ক্যাকটাসের জন্য মাটি তৈরি ও চাষের ক্ষেত্রে টবের মাটি তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলত ক্যাকটাসের চাষে আমাদের দেশে প্ল্যাস্টিক বা মাটির তৈরি টব ব্যবহার করা হয় । এগুলোতে পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা যায়।
ক্যাকটাসের মাটির উপাদান
- মাটি
- বালি (নদী)
- পার্লাইট
- কোকোডাস্ট
- দোঁয়াশ মাটি
- পাতা পচা সার
- গোবর
- হাড়ের গুঁড়ো
- কয়লার গুঁড়ো
উপকারিতা
- ক্যাকটাসের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান যথাযথ পরিমাণে থাকে।
- ক্যাকটাস সয়েলের ঘনত্ব কম তাই বাষ্পীভবন দ্রুত হয়।
- পানি নিষ্কাশন দ্রুত করে।
- পানি জমে থাকে না ফলে ক্যাকটাসের শিকড় পঁচা রোগ রোধ করে।
- ক্যাকটাস সাধারণ যে পরিবেশে জন্মাতে অভ্যস্ত অর্থাৎ মরু পরিবেশ সৃষ্টি করে।
ক্যাকটাসের মাটি
ক্যাকটাসে অন্যান্য গাছের মতো একই মাত্রার জৈব পদার্থ প্রয়োজন হয়না। সাধারণ মাটিতে অনেক বেশি পরিমাণ জৈব পদার্থ থাকে কারণ বেশিরভাগ গাছেই অনেক বেশি পরিমাণ জৈব পদার্থ প্রয়োজন হয়। তাই ক্যাকটাসের মাটি মূলত বেলে মাটি, দানা বালু, ছোট পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়।
ক্যাকটাস মাটিতে সঠিক পিএইচ স্তর বজায় রাখুন
প্রায় সব ধরনের ক্যাকটাসের জন্য সামান্য অম্লীয় মাটির প্রয়োজন হয়। সাধারণত, আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার ক্যাকটাস মাটির পিএইচ স্তর পাঁচ থেকে ছয়টির মধ্যে রয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হল বোতাম ক্যাকটি যা ৬-৭ এর পিএইচ মাত্রার সাথে মাটিতে ভাল হয়ে থাকে। কোকোপিট মাটির সঠিক আম্লত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আর্দ্রতা
ক্যাকটাস এর মাটি এবং সাধারণ মাটির মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল এর আর্দ্রতা ধরে রাখা। সাধারণ মাটিতে জৈব পদার্থ থাকার কারণে এটি আর্দ্রতা ধরে রাখে। ক্যাকটাস সয়েল আর্দ্রতা ধরে রাখে না , যা গাছের মূল পচন রোধেও সাহায্য করে।
বায়ু সঞ্চালন
ক্যাকটাসের সূক্ষ্ম কিছু শিকড় থাকে যা পাত্রের ভেতর যথাযথ বায়ু সঞ্চালনের সাথে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। ক্যাকটাসের মাটির ঘনত্ব অন্য মাটির চেয়ে কম হওয়ার কারণে এর মধ্যে দিয়ে অধিক পরিমাণ বায়ুচলাচল করে যা শিকড়ের বৃদ্ধি এবং মাটি আকড়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
পানি নিষ্কাশন
ক্যাকটাস মূলত দীর্ঘদিন মরু এলাকায় এবং কম আর্দ্রতায় থাকতে অভ্যস্ত। এই পরিবেশের সাথে মিল রেখেই ক্যাকটাসের মাটি তৈরি করা হয় যা দ্রুত পানি নিষ্কাশন করে শুকিয়ে যায় কিন্তু পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। অন্যদিকে সাধারণ মাটির মিশ্রণ এমনভাবে তৈরি করা যেনো তা পানি ধরে রাখতে পারে যা ক্যাকটাসের জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়।
ক্যাকটাসের পাত্র প্রস্তুতি
৬০ ভাগ বালি, ২০ ভাগ পারলাইট( আগ্নেয়গিরির কাচ) ও ২০ ভাগ কোকোপিট (নারকেলের তুষ দিয়ে তৈরি) ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণটিই হলো ক্যাকটাস চাষের জন্য আদর্শ। তবে অনেক সময় পারলাইট বা কোকো পিট এর পরিবর্তে অন্যভাবেও জমি তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে
- 3 ভাগ নিয়মিত মাটি
- 3 অংশ মোটা বালি/ নুড়ি
- 2 পার্লাইট/পিউমিস
এছাড়াও ২০ ভাগ দোআঁশ মাটি ,৩০ ভাগ বালি এবং বাকি ৫০ ভাগ গোবর সার মিশিয়ে ও মাটি তৈরি করা যায়।
উপরে দেয়া নিয়ম গুলো অনুসরন করে প্রথমে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। এরপর টবের বা কাঠের বাক্স ভর্তি করার আগে টবের নিচের ফুটোয় পাতলা কাগজ দিয়ে দুই থেকে তিন ইঞ্চি পরিমাণ ইটের গুঁড়ো বা কয়লার গুড়ো দিয়ে এরপর আপনার তৈরি করা মাটি দিতে হবে। প্রতি এক ফুট সাইজের একটি টবে এক মুঠো হাড়ের গুঁড়ো অথবা দুই চামচ সুপার ফসফেট মিশিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। অবশ্যই রোদযুক্ত স্থানে পাত্র রাখতে হবে।
সার
ক্যাকটাস মাটিতে অতিরিক্ত পুষ্টি যোগ করা এড়িয়ে চলতে হবে। সাধারণত, ক্যাকটাসের মাটিতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি থাকে, । ক্যাকটাসে তরল সার দেয়া যেতে পারে।তরল সার তৈরি করার জন্য ১/২ লিটার পানি তে ১/২ চা চামচ এনপিকে সার (ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ এর সমপরিমাণ মিশ্রণ) মিশাতে হবে। এই মিশ্রণটি স্প্রে করে সমগ্র গাছে ও মাটিতে ১৫ দিন পর পর দিতে হবে। এতে গাছ সতেজ থাকবে এবং বৃদ্ধি ভালো হবে।
ক্যাকটাসে মাটি জীবানুমুক্তকরণ
ব্যবহারের আগে ক্যাকটাস মাটি জীবাণুমুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ন। পটিং মিশ্রণ অণুজীব এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য বেশ সংবেদনশীল। তাই বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ক্যাকটাসের মাটি জীবাণুমুক্ত করার অন্যতম সেরা উপায় হল গরম তাপ দেয়া, সরাসরি মাটি রোদে রাখলেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
আগাছা দমন
আগাছা প্রত্যেক গাছের জন্যই ক্ষতিকর। এতে চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ক্যাকটাস চাষে আগাছা তেমন দেখা যায় না। যেহেতু ক্যাকটাসে পানি সপ্তাহে ১ বার এর বেশি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না তাই আগাছা জন্মায় না বললেও চলে। তবে আগাছা যদি হয়ে থাকে তবে তা হাত দিয়েই পরিষ্কার করা সহজ এবং উত্তম।
সেচ
ক্যাকটাসে শীতকালে পানি দেওয়ার তেমন দরকার হয় না। তবে যদি মূল শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে মাসে ১-২ বার পানি দেওয়া যেতে পারে। বছরের অন্যান্য সময়ে সপ্তাহে ১ বার পানি দিতে হবে। পানির পরিমান :৩ ইঞ্চি সাইজের টবে ২০ মি.লি. পানি, ৫ ইঞ্চি সাইজের টবে ৪০ মি.লি. পানি। তবে ক্যাকটাসকে সরাসরি বৃষ্টির পানিতে ভেজানো যাবে না। বৃষ্টি হলে ক্যাকটাসকে ঘরে নিয়ে আসতে হবে।
রোগ
ক্যাকটাস গাছের তেমন কোনো রোগ বালাই হয় না। তবে অতিরিক্ত পানি দিলে ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। ফলে গাছটি পচে মারা যেতে পারে। এজন্য গাছে পরিমাণের বেশি পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সামান্য পরিমাণে ছত্রাকনাশক গুলে সমস্ত গাছে স্প্রে করা যেতে পারে। এম-৪৫ নামক ছত্রাকনাশকটি এক্ষেত্রে ভালো কাজ করবে।
সংক্ষেপে, ক্যাকটাসের মাটি অবশ্যই ভালভাবে নিষ্কাশন, নন-কমপ্যাক্ট এবং সঠিক বায়ুচলাচলের উপযোগি হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। মনে রাখবেন যে ক্যাকটাস স্যাঁতসেঁতে মাটি পছন্দ করে না কারণ এটি মূল পচা, ছত্রাকজনিত রোগ এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণ হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, ক্যাকটাসের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় হুমকি হল শিকড় পচা কারণ এটি পানি শোষণের মাধ্যমে আক্রমণ করে এবং সহজেই কান্ডে ছড়িয়ে পড়তে পারে । এটি দুর্বল এবং সংকুচিত হয়ে যার, পরশেষে মারা যায়।
অতএব, যদি আপনি আপনার নিজের ক্যাকটাসের মাটি তৈরি করেন, তাহলে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি ভাল মাটির মিশ্রন ব্যবহার করেছেন যা বেশ দ্রুত নিষ্কাশন করবে। সাধারণত, আলগা এবং দানাদার মাটি ক্যাকটি উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য উপযুক্ত।
আপনার মাটির ভাল বায়ুচলাচল ও মাটির ঘনত্ব নিশ্চিত করা উচিত। শিকড়ের শ্বাস -প্রশ্বাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকা দরকার কারণ এটি পানি এবং পুষ্টির শোষণকে সহজ করে তোলে। কম ঘনত্বের মাটি বেশি দিন আর্দ্রতা ধরে রাখে না এবং শিকড়কে শ্বাস নিতে সহায়তা করে।
ক্যাকটাস চাষ একটি শিশুর পরিচর্যার মত। তাই শখের ক্যাকটাস চাষে উদাসীন হলে চলবে না। গৃহমধ্যস্থ গাছের মধ্যে ক্যাকটাস জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এটি আপনার বারান্দা বা জানালায় যোগ করবে আলাদা সৌন্দর্য।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
লিখেছেনঃ কৃষিবিদ নারিফা নুসরাত
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.