কৃত্রিম পরাগায়ন ও ছাদবাগানে সবজির ফলন বাড়ানোর কৌশল

যে পদ্ধতিতে ফুলের পরাগধানী থেকে পরাগরেণু সেই ফুল বা অন্য ফুলের অথবা একই প্রজাতির অন্য কোনো উদ্ভিদের ফুলের গর্ভমুন্ডে স্থানান্তরিত হয়, তাকে পরাগযোগ বা পরাগায়ন (Pollination) বলে। পরাগায়নের ফলেই ফুল থেকে ফল ও বীজ হয় ।

ফল ফসল উৎপাদনের মূলশর্ত হলো অনুকুল পরিবেশে সফল পরাগায়ন ও গর্ভধারণ। প্রায় সব ধরণের ফলের উৎপাদনে পরাগায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পরাগায়ন প্রধানতঃ দু’ভাবে হতে পারে-

  • প্রাকৃতিক ও
  • কৃত্রিম।

অধিকাংশ গাছেই প্রাকৃতিকভাবে পোকা-মাকড়, বাতাস এসবের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত  কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরাগায়নকারী পোকা-মাকড় আশংকাজনকভাবে জমি থেকে কমে যাচ্ছে। এর কারণে যেসব ফসলের ফল গঠন প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিকভাবে ব্যহত হচ্ছে। তাই অনেক ফসলেই এখন কৃত্রিম পরাগায়ন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে। শাক-সবজিসহ অন্যান্য সব ফসলের বেলায় পরাগায়ন অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। সবজির মধ্যে কুমড়া জাতীয় যেসব সবজি রয়েছে যেমন- মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, তরমুজ, করলা, কাঁকরোল, পটল এসব ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম পরাগায়ন করে ফলন বাড়ানো যায়। অনেক সময় দেখা যায় গাছে ফুল ফুটছে প্রচুর: সবজি ও আসছে কিন্তু ফুল ফোটার দু একদিন পরেই সেগুলো শুকিয়ে বা পচে ঝরে যায়। এর কারণ হলো পরাগায়ন না হওয়া। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং অধিক ফলন পেতে হলে কৃত্রিম পরাগায় অবলম্বন করতে হবে।  

কৃত্রিম পরাগায় অবলম্বন করে ৯০ ভাগ পর্যন্ত  ফলন আশা করা যায়।

পরাগায়নের পূর্বশর্ত

কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে হলে প্রথমে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল চিনতে হবে। ফুলের চরিত্র বিচারে ও  বিকাশের ক্ষেত্রে মিষ্টিকুমড়া ও লাউ জাতীয় সবজির প্রায় গাছগুলো্র একই গাছে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটে। অধিকাংশ ফুল একলিঙ্গী তাই একই ফুলের মধ্যে স্ব-পরাগায়ন ঘটার কোন সম্ভাবনা থাকে না। সাধারণভাবে যেসব ফুলের বোঁটায় ফলের একটি আকৃতি থাকে যাকে গর্ভাশয় বলা হয় সেসব ফুলই স্ত্রী ফুল ।

আর যেসব ফুলের গোড়ায় কোন গর্ভাশয় বা এ ধরনের কোন গঠন থাকেনা সেগুলো পুরুষ ফুল। কুমড়া এবং লাউয়ের পুরুষ ফুল আলাদা ফোটে। স্ত্রী ফুলের বোঁটা থাকে খাটো এবং এরাও আলাদাভাবে ফোটে। সাধারণতঃ পুরুষ ও স্ত্রী ফুল গাছের একই পত্রকক্ষে ফোটে ।স্ত্রী ফুলের সংখ্যা যত বাড়ে ফলন ও তত বাড়ে। তবে পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের সংখ্যার বাড়া এবং কমার উপর অনেকটা নির্ভর করে। যেমন- যে জমিতে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া ব্যবহার করা হবে এবং তাপমাত্রা ও দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হবে সে জমিতে পুরুষ ফুল বেশি ফোটে। অন্যদিকে এর বিপরীত হলে স্ত্রী ফুল বেশি ফুটে থাকে।

কৃত্রিম পরাগায়ন অথবা হাতের সাহায্যে পরাগায়ন

পরপরাগায়নের মাধ্যমে কুমড়া জাতীয় সবজির পরাগায়ন ঘটে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়ে পরপরাগায়নের উপর নির্ভর করা হলে বিশেষ করে কুমড়া ও লাউ ফসলের ফলন কম হয়। এজন্য পুরুষ ফুলের পরাগরেণু সংগ্রহ করে বা পুরুষ ফুল দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে ছোঁয়াতে বা ঘষতে হয়। এটাই কৃত্রিম পরাগায়ন। কুমড়া জাতীয় সবজির কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হয়।

পুরুষ স্ত্রী ফুল ফোটার সময়ঃ প্রায় সকল সবজির ফুল সকালেই ফোটে। লাউ এর ফুল দুপুর পর্যন্ত ফোটে ও ফলধারণ ঘটে।

পরাগায়নের উপযুক্ত সময়ঃ কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য উপযুক্ত সময় ও ফুল বেছে নিতে হবে যে সময়ে পরাগায়ন এবং গর্ভাধারন কার্যকরী হয়। একই সময়ে ফোটা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল বেছে নেয়া ভালো। একই সময়ে ফোটা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল না হলে পরাগরেণুর সজিবতা ও গর্ভমুন্ডের পরাগগ্রহনে সামঞ্জস্য হয় না এর জন্য ফলধারণ বিঘ্নিত হয়।

ফুল বাছাইঃ কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হলে সাধারণতঃ সকাল বেলায় একই সময়ে ফোটা পুরুষ ও স্ত্রী ফুল বেছে নিতে হয়। ভোরে এ কাজ করা ভাল।

পরাগায়নঃ পুরুষ ফুলটি গাছ থেকে বোঁটাসহ ছিড়ে তার পাঁপড়ি ফেলে দিতে হবে। এ অবস্থায় বোঁটার উপর শুধু পরাগদন্ডটি রেখে দিতে হবে। কাজগুলি করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পরাগদন্ডের মাথায় যে পরাগধানী ও হলুদ গুঁড়ো গুঁড়ো পরাগরেণু থাকে তা যেন পড়ে না যায় । এবার পুংদন্ডটি হাতে নিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে ঘষে দিতে হবে। এতে গর্ভমুন্ডের আঠালো পদার্থে পরাগ রেনু আটকে যাবে। পরাগায়নের সময় অসংখ্য পরাগরেণুর মধ্যে একটি সক্রিয় পরাগরেণুই ফলধারণের জন্য যথেষ্ট। একটি পুরুষ  ফুল দিয়ে সাধারণ ৫-৬ টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা ভাল এবং  সবজিভেদে ৮-১০টি পুরুষ ফুল দিয়ে একটি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা ভাল। পুরুষ ফুল ছিড়ে সাথে সাথেই পরাগায়ন ঘটানো ভাল।

যেসব বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন

১।রোদ বেশি হলে অনেক সময় গর্ভমুন্ডের আঠালো পদার্থ শুকিয়ে পরাগায়ন ক্ষমতা হারাতে পারে এবং পরাগরেণুর সজীবতা কমে যেতে পারে এজন্য কম তাপমাত্রা ও রোদ কড়া হওয়ার আগে কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটানো ভাল।

২।অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী ফুলে গর্ভমুন্ডের পরাগায়ন ক্ষমতা দুপুর পর্যন্ত থাকে তবু সার্থক ফলধারণের জন্য উপযুক্ত সময়ে সঠিক পরিমাণে পরাগরেণু সংযোগ ঘটানো উচিত। তা না হলে ফলের আকার আকৃতি ছোট ও বিকৃত হতে পারে।

পরাগায়ণের সকল নিয়ম কানুন মেনে সঠিকভাবে কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে পারলে কুমড়া জাতীয় সবজির ফলন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।