বারান্দার টবে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের পরিচর্যা

চন্দ্রমল্লিকা  বিশ্বের জনপ্রিয় মৌসুমি ফুলের মধ্যে অন্যতম। জনপ্রিয়তার দিক থেকে গোলাপের পরই এর স্থান। খ্রিস্টমাসের সময় এ ফুল ফোটে বলে একে ক্রিসেন্থিমাম বলা হয়। জাপান ও চীনদেশই সম্ভবত চন্দ্রমল্লিকার আদি জন্মস্থান। চন্দ্রমল্লিকা জাপানের জাতীয় ফুল। বাংলাদেশেও মৌসুমি ফুল হিসেবে এর চাষ হয়। নানা রং এর বাহার ও গঠনের জন্য একে শরৎ রানী বলা হয়। বাণিজ্যিকভাবে চন্দ্রমল্লিকা চাষের পাশাপাশি, মনের খোরাকে ছাদবাগান বা বারান্দা বাগানকে চন্দ্রমল্লিকায় সাজিয়ে তুলতে পারেন ফুলপ্রেমী বাগানী। চলুন বিস্তারিত জেনে নেই-

জাত

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট  চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বারি চন্দ্রমল্লিকা -১, বারি চন্দ্রমল্লিকা -২, বারি চন্দ্রমল্লিকা -৩ এবং বারি চন্দ্রমল্লিকা -৪  এই চারটি জাত  উদ্ভাবন করেছে। 

বারি চন্দ্রমল্লিকা-

 শীতকালীন চাষ উপযোগী মৌসুমী ফুলের জাত। ২০-২৫ দিনের চারা মাঠে বা টবে লাগানো হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা লাগানোর সঠিক সময়। ডিসেম্বরে ফুল আসতে শুরু করলেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝী পর্যন্ত থাকে। গাছ প্রতি গড়ে ৩০-৩৫ টি ফুল ধরে। ফুলের রং হলুদ । ফুলের সজীবতা ৯-১০ দিন থাকে।

বারি চন্দ্রমল্লিকা- 

দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী শীতকালীন মৌসুমী ফুলের জাত। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা লাগানোর  উপযুক্ত সময়। ২০-২৫ দিনের চারা মাঠে বা পটে লাগানো হয়। ডিসেম্বরে ফুল আসতে শুরু করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝী পর্যন্ত থাকে। গাছপ্রতি গড়ে ৩৫-৪০টি ফুল ধরে। ফুলের রং সাদা হয়। ফুলের সজীবতা ১২-১৪ দিন।

বারি চন্দ্রমল্লিকা–

 শীতকালীন মৌসুমী ফুলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা অন্যতম।  টবে লাগানোর জন্য এর ব্যবহার সর্বাধিক। ফুলের রং মেজেন্টা। প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফুল উৎপাদিত হয় । টবে ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় ১০-১২ দিন থাকে।

বারি চন্দ্রমল্লিকা–

এটি সর্বত্র চাষ উপযোগী শীতকালীন মৌসুমী ফুল। টবে লাগানোর জন্য এর ব্যবহার  ও সর্বাধিক তবে কাট-ফ্লাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফুলের রং টকটকে লাল। প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফুল উৎপাদিত হয়। টবে ফুলের স্থায়িত্ব প্রায় ১০-১২ দিন থাকে।

জলবায়ু মাটি

চন্দ্রমল্লিকা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রৌদ্রজ্জল স্থান পছন্দ করে। বাংলাদেশে শীতকালই এই ফুল চাষের উত্তম সময়। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিস্কাশিত দো আঁশ ও বেলে মাটি চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ ৬.০-৭.০ চন্দ্রমল্লিকার জন্য সবচেয়ে ভালো ।

বংশ বিস্তার

 বীজ, সাকার ও শাখা কলম থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়।

চারা তৈরি

 বীজ থেকে চারা করলে তা থেকে ভাল ফুল পাওয়া যায় না এবং ফুল পেতে অনেক দিন লেগে যায়। অন্য দিকে ডাল কেটে শাখা কলম করলে বা সাকার থেকে চারা করলে এ সমস্যা থাকে না। এদেশে শাখা কলম করে চারা তৈরি অধিক প্রচলিত।

চারা রোপন

টবে চারা রোপনের উপযুক্ত সময় অক্টেবর- নভেম্বর।

টবের মাটি তৈরী

৩ ইঞ্চি বা ৭-৮ সেমি. মাপের ছোট টবের ২ ভাগ পাতাপচা সার, ২ ভাগ সাধারণ মাটি, ১ ভাগ গোবর সার ও তার সঙ্গে কিছুটা লাল বালি মিশিয়ে সার মাটি তৈরী করতে হবে। ১২-১৩ সেমি. ও ২০- ৩০সেমি.মাপের টবের জন্য ৩ ভাগ সাধারণ মাটি, ৩ ভাগ পাতাপচা সার ও চার ভাগ গোবর সার মিশিয়ে সারমাটি তৈরী করতে হবে।

বর্ষাকালে টবগুলি সরিয়ে কোন আচ্ছাদিত স্থানে রাখতে হবে।

টবে চন্দ্রমল্লিকা

  • জুলাইয়ের শেষের দিকে চন্দ্রমল্লিকার কাটিং  প্রথমে ৩ ইঞ্চি বা ৭ সেমি. মাপের ছোট টবে বসাতে হবে।
  • ১৫- ২০ দিন পর শিকড় সহ কাটিং ৫ ইঞ্চি বা ১২-১৩ সেমি. মাপের টবে লাগাতে হবে।
  • আগষ্টের ২য় সপ্তাহের মধ্যে টব পরিবর্তনের কাজটি করতে হবে। এক মাস পরে চারা ৮-১০ ইঞ্চি বা ২০- ৩০সেমি. মাপের বড় টবে বা বাগানে লাগাতে হবে।

সেচ

 চন্দ্রমল্লিকার চারা বিকালে লাগিয়ে গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চন্দ্রমল্লিকার চারা লাগানোর পর সামান্য পানি  দিতে হবে। চন্দ্রমল্লিকা গাছ কখনো বেশি পানি সইতে পারে না। তাই পানি এমনভাবে দিতে হবে যেন গোড়ায় বেশিক্ষণ পানি জমে না থাকে। চারা রোপণের পূর্বে এবং পরে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পরিমানমত পানি  দেয়া জরুরি। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য অবশ্যই টবের নিচে ছিদ্র করে নিতে হবে।

 টবে সার প্রয়োগ

পটে জন্মানোর জন্য ২ ভাগ মাটি, ২ ভাগ গোবর সার, ১ ভাগ পাতা পচা সার ও ১ ভাগ হাড়ের গুঁড়ার সাথে ৩ গ্রাম টিএসপি, ৩ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ এর মিশ্রণ ব্যবহার করা উত্তম। ৮ গ্রাম ইউরিয়া সারের অর্ধেক সাকার/কাটিং রোপণের ২৫-৩০ দিন পর গাছের দৈহিক বৃদ্ধির সময় এবং বাকি অর্ধেক ফুলের কুড়ি আসার সময় প্রয়োগ করা উচিত।

রোগবালাই দমন ব্যবস্থা

পাউডারী মিলডিউ: এ রোগ হলে গাছের পাতার উপর সাদা থেকে ধূসর গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে এবং আস্তে আস্তে পাতা কুকড়িয়ে নষ্ট হয়ে যায়। বেশি আক্রমণে পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।

রোগ দমনঃ

  • মাঠে যথাযথ রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • সোডিয়াম বাইকার্বোনেট (যেমন-বেকিং সোডা) ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৫ বার স্প্রে করতে হবে।

পাতায় দাগ পড়া বা ঝলসানো রোগঃ এ রোগের আক্রমণে প্রথমে নিচের পাতায় হলদে দাগ পড়ে এবং আক্রমণের মাত্রার উপর নির্ভর করে বাদামী থেকে কালো দাগে পরিণত হয়।

রোগ দমনঃ

  • গাছের গোড়াতে খড় জাতীয় মালচ্ ব্যবহার করলে তলার পাতার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম থাকে।
  • পরিমিত সেচ প্রদান করতে হবে এবং সেচের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গোড়ার পাতা না ভিজে।

গ্রে মোল্ড: এ রোগের আক্রমণে ফুলের পাঁপড়ি, পাতা এমনকি কাণ্ডেও বাদামী পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছে ধূসর থেকে বাদামী পাউডারের মত আস্তরণ পড়ে। দীর্ঘকালীন আর্দ্র ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে খুবই সহায়ক।

রোগ দমনঃ

  • এ রোগ দমনে রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছকে পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা: চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত জাব পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়।

জাবপোকা: এ পোকা খুব ছোট আকৃতির, নরম ও কালো-সবুজ বর্ণের। শীতকালে এর প্রকোপ খুব বেড়ে যায়। এ পোকা গাছের পাতা, ডগা এবং ফুল থেকে রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। আক্রান্ত নতুন কুঁড়ি ও পাতা কুঁকড়ে যায়।

দমন ব্যবস্থাঃ

  • এ পোকা দমনে প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত পাতা বা ফুল ছিঁড়ে ফেলে পোকাসহ ধ্বংস করা উচিত।
  • সাবান গুঁড়া ৫ গ্রাম/লিটার হারে পনিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যেতে পারে।

ফুল সংগ্রহ

চন্দ্রমল্লিকা ফুল কুঁড়ি অবস্থায় তুললে ফোঁটে না। বাইরের পাপড়ি গুলো সম্পূর্ণ খুলে গিয়েছে এবং মাঝের পাপড়ি গুলো ফুটতে শুরু করেছে এমন অবস্থায় খুব সকালে অথবা বিকেলে ধারালো ছুরি দিয়ে দীর্ঘ বোঁটাসহ কেটে ফুল তোলা উচিত।

ফলনঃ

জাত ভেদে ফলন কম বেশি হয়। তবে গাছ প্রতি বছরে গড়ে ৩০-৪০ টি ফুল পাওয়া যায়।